ডঃ তারকরঞ্জন গুপ্ত
।।১।।
পুজো ঠিক কখন আসে? ঠিকঠাক জানি না। তবে ছোটবেলায় সাত সকালে আধ ঘুমের মধ্যে মায়ের ঠান্ডা হাত ছুঁয়ে যেত কপাল, গাল ! কানে ঢাকের আওয়াজ ! পাড়ার প্যান্ডেল থেকে নতুন একটা গন্ধ ভেসে ভেসে আসছে । চারিদিকে কি রকম একটা অন্য সুর, সাতসকালটা একটু অন্য রকম. মা বলতো আজ মহা ষষ্টি । স্কুল নেই, ক্লাস নেই, মাও যেন একটু অন্যরকম আজকে! কোনো পড়তে বসা নেই! কিন্তু অনেক অনেক কিছু আছে। ঢাকের ওই বোলে সব কিছু একসঙ্গে শুরু হয়ে গেলো। নতুন শাড়ির গন্ধ। মা আজ অন্য রকম। একটু পরেই মাসিমা চলে আসবে। “কি জামা পরে ঠাকুর দেখতে যাবে আজ বাবু?” … বারান্দার নিচ থেকে শুনতে পাবো “বুড়ো বাবু ? উঠে পড়ো ” মেসোমশাই দাঁড়িয়ে পড়েছেন ….. মা এসেছেন, মা অন্যরকম! এক মা হাত ভর্তি ফুল নিয়ে অন্য মায়ের অঞ্জলি দিচ্ছেন ! দুই মা দেখছেন একে অপরকে !
।।২।।
পুজো এলো ! IIT র হোস্টেল থেকে সব বন্ধুরা বাড়ি ফিরে যাচ্ছে! সারা ট্রেন মশগুল! প্ল্যানিং! কোথায় দেখা হবে, কোথায় খাওয়া ! ট্রেন এর জানলায় আমি দেখতে দেখতে চলেছি উপচে পড়া কাশফুল ! বাড়ি ফিরে ব্যাগ রেখেই এদিক ওদিক দেখা! মা কোথায় ? মামার বাড়ি গেছে। একটু পরেই ফিরে আসবে। হাতে সময় বড় কম ! প্রথম ফোন তার বাড়ির নাম্বারে
” বাড়ি ফিরেছি । এই মাত্রা।”
“ও আচ্ছা! আমরা তো বিষ্ণুপুরে যাবো আজকেই । ” বাবা মা ভাই ।”
“আচ্ছা ফিরে এস, পরে কথা হবে ”
“ভালো আছো?”
পুজোর সকাল কি রকম মন খারাপ কর দিয়ে গেলো।” তার চোখ ভেসে উঠলো সামনে । দূর্গা মায়ের চোখের আড়ালে তার চোখ দেখলাম যেন ! মনে মনে আমিও চাইলাম যেতে, কিন্তু পারলাম না ! কি করে কাটাবো বাকি চারদিন? ফোন নেই, কথা বলা নেই! অভিমানে শুরু হলো পুজো। প্রথম না পাবার কষ্ট !
।।৩।।
পুজো এসেছে ! কলকাতা থেকে মাসতুতো দাদার ফোন ” মা কে ICU তে দিয়েছে ! অপারেশন তো ঠিক হয়েছিল, কিন্তু কি হলো বলতো ?” চোখের সামনে মায়ের মূর্তি আস্তে আস্তে জলছবি হয়ে গেলো । পুজোর শুরুর দিনে আর মন থাকলো না পুজোয় । অষ্টমী র রাতে চলে গেলো বড় মাসিমা ! জিজ্ঞেস করলে না তো ” আজ কি জামা পরে ঠাকুর দেখতে যাবে ….?” অষ্টমী তে আমার আরেক মা চলে গেলেন বিসর্জনে !
।।৪।।
পুজো শুরু ! “সোনামনি কে নিয়ে আজ ঠাকুর দেখতে যাবি তো ?” মায়ের ফোন কলকাতা থেকে!
“তুমি যাবে না মা?”
” নাহ শরীর ভালো নেই।”
“মায়ের কাছে একবার যাও , পাড়াতেই তো ঠাকুর ! শরীর ভালো হয়ে যাবে” ।
উত্তর এলো, আর তো কটা দিন ! একেবারেই চলে যাবো !
দুই মা এক হয়ে গেলো একদিন! কাছে পাই না! ফোন করতে পারি না! কিন্তু বুঝতে পারি! মা আসেন! মা এসেছেন! আজ যে পুজো! দূরে দাঁড়িয়ে দেখছি , দেখছি মায়ের অঞ্জলি দেওয়া!
।।৪।।
পুজো শুরু আজ! সকালে মণ্ডপের নিচে দাঁড়িয়ে আছি! ছেলে স্কুল থেকে পরীক্ষা দিয়ে ফিরবে ! অটো থেকে নেমে পড়লো সে! ” চল ওপরে মা অপেক্ষা করছে তোর জন্যে !” সিঁড়ি দিয়ে ছেলের পাশাপাশি ওপরে উঠছি । ভাবলাম বলি “কোন মা, বললাম বুঝলি ? আজ মা এসেছে ” … ভাবলাম না থাক । আজ তো সবার মা এসেছে। সব হারিয়ে যাওয়া মায়েরা সব এসে গেছে ! আজ তো পুজো শুরু !